“বিক্রয়ের জন্য
নয়”
মুহাম্মদ
শহিদুল ইসলাম মুহিত, কৃষি প্রকৌশল অনুষদ, বাকৃবি
জেএভিপি, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি.
অত্যন্ত
সহজবোধ্য এবং বহুল প্রচলিত একটি কথা “বিক্রয়ের জন্য নয়”। আমাদের মননশীলতা ও
নৈতিকতার উপর সহজ এই কথাটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কথাটি ছোট হলেও মানব জীবনে এর
প্রভাব ব্যাপক এবং বিস্তৃত। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার রচিত একটি গানে
লিখেছেন-
ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি
আমার দেশের মাটি।
...
এই মাটিরই কাঁদা মেখে
এই দেশেরই আচার দেখে
সভ্য হলো নিখিল ভূবন
দিব্য পরিপাটি।
গানটিতে কবি
দেশ-মাতৃকার বন্দনা করেছেন নানা আঙ্গিকে, সেইসাথে একটি
বিষয় তিনি তুলে ধরেছেন সুনিপুণ ভাবে আর সেটি হলো- এই দেশের আচার অনুষ্ঠান, শিষ্টাচার দেখেই বিশ^জনেরা সভ্য হয়েছে। কিন্তু কবির এই
কথার সত্যতা কি আমরা আমাদের সমাজে এখনও খুঁজে পাই? আমরা কি আজও নিজেদের পরিপাটি রাখতে পেরেছি? নিজেদের
অস্তিত্ব,
অতীত ঐতিহ্য কি আমরা ধরে রেখেছি নাকি সময়ের ¯্রােতে নিজেদের চিন্তা চেতনাকে বিক্রি করে দিয়েছি, সেই ভাবনা থেকেই আজকের বিষয়বস্তুর উপর আলোচনার অবতারণা।
আমাদের দেশে
খবরের কাগজ বিশেষ করে জাতীয় দৈনিক গুলোর বিশেষ দিবস বা পত্রিকার জন্মদিনকে
উপলক্ষ্য করে বিশেষ সংখ্যা বা ক্রোড়পত্র প্রকাশ করার একটা রেওয়াজ দীর্ঘ দিন ধরেই
চলে আসছে। বিশেষ দিনে পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখা মেলে মূল পত্রিকার সাথে ভিন্ন
কলেবরে প্রকাশিত আরেকটি পত্রিকা। পত্রিকার বিশেষ এই সংখ্যাটি সাজানো থাকে
বৈচিত্র্যময় নানা বিষয়বস্তুর মাধ্যমে। কি থাকে না এই সংখ্যাটিতে-রাজনীতি, সমাজ,
সংস্কৃতি কোন কিছুই বাদ যায়না। দেশী-বিদেশী স্বনামধন্য
কবি-সাহিত্যিকের নতুন পুরাতন লেখনী, বিজ্ঞান, গবেষণা, সমসাময়িক কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা
আলোচনা পর্যালোচনা বিশেষ এই সংখ্যাটিকে করে তোলে জ্ঞান অর্জনের এক আঁধার হিসেবে।
সময়ের পরিক্রমায় ডিজিটালাইজেশনের কারনে বই বা পত্রিকার দিকে মানুষের আগ্রহ কমে
গেলেও সাদা কাগজে লেখা কালো অক্ষরের আবেদন কখনওই ডিজিটাল ভার্সন পূরণ করতে পারবে
না। এক সময় পত্রিকার এই বিশেষ সংখ্যা সংগ্রহ করার জন্য তাই রীতিমত যুদ্ধ করতে হত।
পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার উপর এত আলোচনা করার উদ্দেশ্য হলো বিশেষ এই সংখ্যার উপরে
গোটা গোটা অক্ষরে লেখা একটি কথা- ”বিক্রয়ের জন্য নয়”। অর্থ্যাৎ, মূল পত্রিকাটি ক্রয় করলে ক্রেতা বিনামূল্যে এটি অংশটি প্রাপ্য হবেন।
“বিক্রয়ের জন্য
নয়”- কথাটির ব্যবহার আমরা আরও অনেক জায়গায় দেখতে পাই। যেমন দোকান বা শো-রুমে কিছু
পন্যের উপর এই লেবেল লাগানো থাকে এই উদ্দেশ্যে যে, পন্যটি দেখে ক্রেতা যেন একই ধরনের পন্য কিনতে আগ্রহী হয়। আবার কোন পন্যের মান
পরীক্ষার জন্য তৈরীকৃত পণ্যেও লেবেলটি ব্যবহার হতে দেখা যায়। সরকারীভাবে যেসব পন্য
বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় যেমন হাসপাতালের ঔষধ, ত্রাণ সমগ্রী
ইত্যাদিতেও ’বিনামূল্যে বিতরণের জন্য’ বা ’বিক্রয়ের জন্য নয়’ কথাটি ব্যবহার একটি
স্বতসিদ্ধ বিষয়।
একটি লোককথার
সাথে আমরা সবাই কমবেশি সবাই পরিচিত আর তা হলো ’মা-কে হাটে ওঠানো’। সুপ্রাচীন কালে
এক লোভী ও স্বার্থপর ব্যাক্তি তার ঋণ পরিশোধের জন্য নিজের মা-কে বিক্রয়ের
উদ্দেশ্যে হাটে উঠিয়ে চরম নৈতিক অধঃপতনের পরিচয় দিয়েছিল। সেই থেকে ‘মা-কে হাটে
ওঠানো’ জগতের সবচেয়ে ঘৃণ্য ও লজ্জাজনক কাজের পরিচয় বহন করে। অর্থাৎ যে নিজের
মা’য়ের সম্মান বিক্রি করতে পারে, তার কাছে অন্য কোন
কিছুই পবিত্র নয়। মা’য়ের সম্মান ও ভালবাসার মত জীবনের আরও কিছু বিষয় যেমন সততা, আত্ম-সম্মান, দেশপ্রেম এগুলোও কোন অর্থের
বিনিময়ে কিক্রয় করা যায় না।
বাংলাদেশের
মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে গর্বের, অহংকারের একটি বিষয়
হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই
মুক্তিযুদ্ধকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আমরা পন্যের
পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছি। বিভিন্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করার জন্য একক ও গোষঠীগত ভাবে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে
ভূলুন্ঠিত করার প্রয়াস আমরা অহরহ দেখতে পাই। এ কারনেই একটি স্বাধীন ভূখন্ড পেলেও
পকৃত মুক্তির স্বাদ আমরা এখনও পাইনি। তাই, মৌলিক
মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য এদেশের মানুষকে আজও সংগ্রাম করে যেতে হয়। শাসন-শোষন
আর জুলুমের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সময়ে সময়ে গড়ে ওঠে গণ-আন্দোলন।
সর্বশেষ যে
গণ-আন্দোলন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তা হলো জুলাই-২০২৪ এর গণ-অভ্যুত্থান। আমাদের
জাতীয় জীবনে এটি আরেকটি মাইলফলক। ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লিখে রাখার মত
আরেকটি দিন হলো ৫ আগস্ট যাকে আমরা ৩৬ জুলাই হিসেবে অভিহিত করি। হাজারো তরুণের তাজা
প্রাণের বিনিময়ে, ফ্যাসিবাদের জগদ্বল পাথর
সরিয়ে আমরা পেয়েছি নতুন এক বাংলাদেশ। কিন্তু বছর না পেরোতেই আমরা দিব্য চোখে
প্রত্যক্ষ করছি- জুলাই এর চেতনা এখন পণ্য হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। যে যেভাবে পারছে
জুলাই-যোদ্ধা হিসেবে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছে। গণ-মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন তাই সুদূর
পরাহতই রয়ে গেছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যারা নীতি-নৈতিকতার মানদন্ডে নিজেদের জীবনকে পরিচালিত করতে পারেনি, সাময়িক অর্থ-ক্ষমতার অধিকারী হলেও তাদের স্থান হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে।
পরিশেষে দৃষ্টি
আকর্ষণ করব মহাপবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআনের সূরা আল ইমরানের ৭৭নং আয়াতের সতর্কবাণীর প্রতি যেখানে বলা হয়েছে-
‘যারা আল্লাহর
প্রতিশ্রুতি ও নিজের শপথ স্বল্প মূল্যে বিক্রয় করে, পরকালে তাদের কোন অংশ নেই। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে (দয়ার দৃষ্টিতে) চেয়ে দেখবেন না, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’
তাই এটুকু আশা
আমরা করতেই পারি, যারা মা-মাটি-দেশ ও আত্মপরিচয় ভুলে, পার্থিব লাভের আশায় সবকিছুকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করে দিতে চায় তারা আল-কুরআনের
উল্লিখিত মর্মবাণী থেকে শিক্ষা লাভ করবে এবং আলোর পথে, কল্যাণের পথে ফিরে আসবে।
0 Comments
No comments yet. Be the first to comment!